https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Trust.webp
Breaking News

মেয়েদের মুখের অবাঞ্ছিত লোম: হরমোনের সমস্যা নাকি অন্য কিছু? কারণ ও দূর করার ৫টি নিরাপদ উপায়

top-news
  • 16 Dec, 2025
https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/eporichoy.webp

আয়নায় নিজেকে দেখে মন খারাপের দিন শেষ

বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে খুব সাধারণ অথচ অত্যন্ত গোপন একটি মানসিক যন্ত্রণার নাম হলো ‘হারসুটিজম’ বা মুখে অতিরিক্ত লোম গজানো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের থুতনি বা ওপরের ঠোঁটের (Upper Lip) দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করেন না, এমন কিশোরী বা তরুণী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমাদের সমাজে মেয়েদের ত্বক হবে মাখনের মতো মসৃণ—এমন এক অলিখিত নিয়ম চালু আছে। সেখানে সামান্য লোম দেখা দিলেই শুনতে হয়, "কিরে, তোর তো ছেলেদের মতো দাড়ি গজাচ্ছে!"

এই কথাগুলো শুধু বিব্রতকরই নয়, মানসিকভাবেও খুব আঘাত দেয়। অনেক সময় আমরা না বুঝেই পার্লারে দৌড়াই, ওয়াক্সিং করি বা সুতা দিয়ে থ্রেডিং করি। কিন্তু আপনি কি জানেন, অনেক সময় এটি শুধু ত্বকের সমস্যা নয়, বরং শরীরের ভেতরের কোনো জটিল হরমোনাল সমস্যার সংকেত?

আজকের এই আর্টিকেলে আমরা একদম খোলামেলা আলোচনা করব—কেন মেয়েদের মুখে এই অবাঞ্ছিত লোম গজায়, এর পেছনে লুকিয়ে থাকা কারণগুলো কী, এবং ঘরোয়া উপায় থেকে শুরু করে লেজার ট্রিটমেন্ট পর্যন্ত সবকিছুর ভালো-মন্দ দিক।


পর্ব ১: কেন গজায় মুখে অতিরিক্ত লোম? (আসল কারণ খুঁজুন)

সমস্যার সমাধান করার আগে সমস্যার মূল কারণ জানা জরুরি। ডাক্তারি ভাষায় মেয়েদের মুখে বা শরীরে পুরুষের মতো লোম গজানোকে বলা হয় ‘হারসুটিজম’ (Hirsutism)। এর প্রধান কারণগুলো নিচে দেওয়া হলো:

১. পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (PCOS):
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি ৫ জন নারীর মধ্যে ১ জন পিসিওএস-এ আক্রান্ত। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে নারীর শরীরে পুরুষ হরমোন বা 'এন্ড্রোজেন'-এর মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে অনিয়মিত মাসিক, ওজন বৃদ্ধি এবং মুখে (বিশেষ করে থুতনিতে) মোটা ও কালো লোম দেখা দেয়।

২. বংশগত বা জেনেটিক কারণ:
আপনার মা, খালা বা নানি-দাদির যদি মুখে লোম বেশি থাকে, তবে আপনারও তা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এশিয়ান বা দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের জিনেটিক্যালি লোম একটু বেশিই থাকে।

৩. ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ, বা নির্দিষ্ট কিছু হরমোনাল ইনজেকশন দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে মুখে লোম গজাতে পারে।

৪. মেনোপোজ:
বয়স বাড়ার সাথে সাথে, বিশেষ করে ৪০-৫০ বছরের পর নারীদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে যায়, ফলে মুখে হালকা লোম দেখা দিতে পারে।


পর্ব ২: প্রচলিত ভুল ধারণা ও বাস্তবতা (Myth vs Fact)

আমাদের সমাজে মুখের লোম নিয়ে কুসংস্কারের শেষ নেই। চলুন কিছু ভুল ধারণা ভেঙে দিই।

  • ভুল ধারণা: রেজার বা শেভ করলে লোম মোটা হয়ে যায় এবং বেশি গজায়।

    • বাস্তবতা: এটি সম্পূর্ণ ভুল। লোমের গোড়া মোটা হয়, আর আগা সরু হয়। শেভ করলে লোম গোড়া থেকে কাটা পড়ে বলে যখন আবার গজায়, তখন হাত দিলে খসখসে লাগে। কিন্তু লোমের সংখ্যা বা ঘনত্ব বাড়ে না।

  • ভুল ধারণা: হলুদ মাখলে লোম পড়ে যায়।

    • বাস্তবতা: কাঁচা হলুদ লোমের বৃদ্ধি কিছুটা ধীর করতে পারে, কিন্তু এটি পার্মানেন্টলি লোম দূর করতে পারে না।

  • ভুল ধারণা: বারবার থ্রেডিং করলে লোম কমে যায়।

    • বাস্তবতা: উল্টো বারবার থ্রেডিং বা ওয়াক্সিং করলে ত্বকের পোরস বা লোমকূপ ঢিলা হয়ে যেতে পারে এবং চামড়া ঝুলে যেতে পারে।


পর্ব ৩: লোম দূর করার নিরাপদ পদ্ধতি (Temporary & Permanent)

লোম দূর করার জন্য আপনি কোন পদ্ধতি বেছে নেবেন, তা নির্ভর করে আপনার ত্বক কতটা সংবেদনশীল (Sensitive) এবং আপনার বাজেট কত তার ওপর।

১. ফেস শভিং বা ডার্মাপ্লানিং (Dermaplaning)

বর্তমান যুগে বিউটি ব্লগারদের কল্যাণে এটি খুব জনপ্রিয়। ফেস শভিং রেজার ব্যবহার করে লোম দূর করা সবচেয়ে ব্যথামুক্ত উপায়।

  • সুবিধা: কোনো ব্যথা নেই, ত্বক ইনস্ট্যান্ট ব্রাইট দেখায়, মেকআপ খুব ভালো বসে।

  • সতর্কতা: সাধারণ বডি রেজার ব্যবহার করবেন না। মুখের জন্য আলাদা ‘আইব্রো রেজার’ বা ‘টিংকলে রেজার’ ব্যবহার করুন। ব্যবহারের আগে অবশ্যই অ্যালোভেরা জেল বা ফেস অয়েল লাগিয়ে নিতে হবে।

২. থ্রেডিং এবং ওয়াক্সিং (Threading & Waxing)

আমাদের দেশের পার্লারগুলোতে এটিই সবচেয়ে বেশি চলে।

  • সুবিধা: লোম গোড়া থেকে উঠে আসে, তাই লোম গজাতে সময় লাগে (১৫-২০ দিন)।

  • অসুবিধা: প্রচন্ড ব্যথা হয়। অনেকের ত্বকে লাল চাকা বা র‍্যাশ (Rash) হয়ে যায়। সেনসিটিভ ত্বকের জন্য ওয়াক্সিং খুব একটা ভালো নয়, এতে ত্বক পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

৩. লেজার হেয়ার রিডাকশন (Laser Hair Reduction)

যদি আপনি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান চান এবং পকেটে বাজেট থাকে, তবে লেজার হলো সেরা অপশন। বাংলাদেশে এখন অনেক ভালো মানের ডার্মাটোলজি ক্লিনিক আছে।

  • কিভাবে কাজ করে: লেজার রশ্মি লোমের গোড়ায় থাকা মেলানিনকে টার্গেট করে এবং লোমকূপ ধ্বংস করে দেয়।

  • খরচ ও সেশন: সাধারণত ৬ থেকে ১০টি সেশন লাগে। খরচ ক্লিনিক ভেদে ভিন্ন হতে পারে, তবে এটি পার্মানেন্ট সমাধানের কাছাকাছি নিয়ে যায়।

  • সতর্কতা: অবশ্যই অভিজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে করবেন। হাতুড়ে কোনো পার্লারে লেজার করালে ত্বক পুড়ে কালো হয়ে যেতে পারে।

৪. ইলেকট্রোলাইসিস (Electrolysis)

এটিই একমাত্র পদ্ধতি যা এফডিএ (FDA) স্বীকৃত ১০০% পার্মানেন্ট হেয়ার রিমুভাল পদ্ধতি। এতে প্রতিটি লোমের গোড়ায় ইলেকট্রিক শক দিয়ে তা নষ্ট করে দেওয়া হয়। এটি বেশ সময়সাপেক্ষ এবং কিছুটা যন্ত্রণাদায়ক।


পর্ব ৪: ঘরোয়া টোটকা (যা আসলেই কাজ করে)

যাদের ত্বক খুব সেনসিটিভ বা যারা কেমিক্যাল ব্যবহার করতে চান না, তারা কিছু ঘরোয়া প্যাক ট্রাই করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, এগুলো লোম পুরোপুরি দূর করবে না, শুধু গ্রোথ কমাবে।

বেসন ও হলুদের প্যাক:

  • উপকরণ: ২ চামচ বেসন, ১ চিমটি কাঁচা হলুদ বাটা, ১ চামচ দুধ।

  • ব্যবহার: সব মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। মুখে লাগিয়ে শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। এরপর ভেজা হাতে লোমের উল্টো দিকে (Circular motion) ঘষে তুলে ফেলুন। এটি স্ক্রাবিংয়ের কাজ করে এবং নিয়মিত ব্যবহারে লোম দুর্বল হয়।

চিনি ও লেবুর ওয়াক্স:
চিনি, লেবুর রস এবং পানি জ্বাল দিয়ে ঘন শিরা তৈরি করে ন্যাচারাল ওয়াক্স হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এটি বাজারের কেমিক্যাল ওয়াক্সের চেয়ে নিরাপদ।


পর্ব ৫: কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?

যদি দেখেন হঠাৎ করেই খুব দ্রুত মুখে এবং বুকে লোম গজাচ্ছে, গলার স্বর ভারী হয়ে যাচ্ছে, বা মাথায় টাক পড়ছে—তবে দেরি না করে একজন এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট (হরমোন বিশেষজ্ঞ) বা গাইনোকোলজিস্টের পরামর্শ নিন। কারণ এটি ওভারিয়ান টিউমার বা এড্রেনাল গ্ল্যান্ডের সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। পিসিওএস থাকলে শুধু লোম তুলে লাভ নেই, সাথে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন ও ওষুধ খাওয়া জরুরি।


সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)

প্রশ্ন: আমি কি প্রতিদিন ফেস শেভ করতে পারব?
উত্তর: না, প্রতিদিন শেভ করলে ত্বকের ব্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সপ্তাহে ১ বার বা ১০ দিনে ১ বার করা ভালো।

প্রশ্ন: লেজার করলে কি ক্যান্সার হয়?
উত্তর: না, লেজার রশ্মি ত্বকের গভীরে গিয়ে কোনো ক্ষতি করে না, এটি শুধু লোমকূপ টার্গেট করে। এটি নিরাপদ।

প্রশ্ন: হরমোনের ওষুধ খেলে কি লোম চলে যাবে?
উত্তর: ওষুধ নতুন লোম গজানো বন্ধ করে, কিন্তু যেগুলো অলরেডি গজিয়ে গেছে সেগুলোকে দূর করতে লেজার বা অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে।


উপসংহার

মুখের লোম কোনো রোগ নয়, এটি একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া। তবে এটি যদি আপনার আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়, তবে তা দূর করার অধিকার আপনার আছে। হুজুগে কান না দিয়ে বা সস্তা রং ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার না করে বিজ্ঞানসম্মত উপায় বেছে নিন। আর সবচেয়ে বড় কথা, নিজের শরীরকে ভালোবাসুন। মনে রাখবেন, সৌন্দর্য নিখুঁত ত্বকে নয়, আপনার ব্যক্তিত্বে।

https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Genus.webp

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *