জন্ম থেকে ১ বছর: মাস অনুযায়ী শিশুর যত্ন ও বেড়ে ওঠার পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন (বাংলাদেশি বাবা-মায়ের জন্য)
নতুন অতিথির আগমনে আনন্দের সাথে দায়িত্বও বাড়ে
পর্ব ১: নবজাতক থেকে ৩ মাস (মানিয়ে নেওয়ার সময়)
১ম মাস: শুধু ঘুম আর দুধ খাওয়া
খাবার: জন্মের ১ ঘণ্টার মধ্যে শালদুধ (Colostrum) খাওয়ানো বাধ্যতামূলক। এটি শিশুর প্রথম টিকা হিসেবে কাজ করে। প্রথম ৬ মাস মায়ের বুকের দুধ ছাড়া এক ফোঁটা পানিও খাওয়ানো যাবে না। নাড়ির যত্ন (Umbilical Cord): নাড়িতে কোনো অ্যান্টিসেপটিক, হেক্সিসল বা তেল লাগাবেন না। এটি শুকনো রাখুন, ৭-১৪ দিনের মধ্যে এমনিতেই পড়ে যাবে। নাড়ি দিয়ে দুর্গন্ধ বা পুঁজ বের হলে দ্রুত ডাক্তার দেখান। গোসল: নাড়ি না পড়া পর্যন্ত স্পঞ্জ বাথ (ভেজা কাপড় দিয়ে গা মোছানো) দিন। এরপর কুসুম গরম পানিতে গোসল করান। সতর্কতা: বাবুকে কেউ কোলে নেওয়ার আগে অবশ্যই হাত ধুয়ে নিতে বলবেন। আমাদের দেশে মেহমানরা এসেই বাচ্চার মুখে চুমু দেন, যা ইনফেকশনের বড় কারণ। এটি ভদ্রভাবে এড়িয়ে চলুন।
২য় মাস: হাসির ঝিলিক ও টিকা
টিকা (Vaccination): বাংলাদেশে ইপিআই (EPI) শিডিউল অনুযায়ী দেড় মাস বা ৬ সপ্তাহ বয়সে পেন্টাভ্যালেন্ট, ওপিভি, পিসিভি টিকা দিতে হয়। টিকা দেওয়ার পর বাচ্চার জ্বর আসতে পারে, এতে ভয়ের কিছু নেই। ডাক্তারের পরামর্শে প্যারাসিটামল ড্রপ দিতে পারেন। ম্যাসেজ: খাটি নারকেল তেল বা অলিভ অয়েল দিয়ে হালকা হাতে ম্যাসাজ করতে পারেন। তবে সরিষার তেল বাচ্চার ত্বকের জন্য ঝাঁঝালো হতে পারে, তাই সাবধান। ঘুমের রুটিন: দিন ও রাতের পার্থক্য বোঝাতে দিনের বেলা ঘরে আলো রাখুন এবং রাতে ঘর অন্ধকার ও শান্ত রাখুন।
৩য় মাস: ঘাড় শক্ত হওয়া (Neck Control)
টামি টাইম (Tummy Time): জেগে থাকা অবস্থায় শিশুকে পেটের ওপর শুইয়ে দিন। এটি ঘাড় ও পিঠের মাংসপেশি শক্ত করতে সাহায্য করে। তবে অবশ্যই আপনার নজরদারিতে রাখবেন। হাত চোষা: শিশু নিজের হাত মুখে দেবে। এটি তার নিজেকে শান্ত করার (Self-soothing) প্রক্রিয়া। এটি নিয়ে চিন্তিত হবেন না, শুধু হাত পরিষ্কার রাখুন।
পর্ব ২: ৪ থেকে ৬ মাস (বিকাশের নতুন ধাপ)
৪র্থ মাস: গড়াগড়ি ও শব্দ করা
নিরাপত্তা: বাচ্চাকে বিছানায় একা রাখবেন না। আমাদের দেশে বিছানা থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনা এই বয়সেই বেশি ঘটে। বালিশ দিয়ে ব্যারিকেড দিন অথবা ফ্লোর ম্যাট ব্যবহার করুন। খেলনা: উজ্জ্বল রঙের ঝুনঝুনি বা শব্দ হয় এমন খেলনা দিন। এটি তার দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি বাড়াবে।
৫ম মাস: শক্ত খাবার খাওয়ার প্রস্তুতি
দাঁতের শিরশিরানি: এই সময় মাড়িতে সুড়সুড়ি বা ব্যথা হতে পারে। শিশু সবকিছু কামড়াতে চাইবে। পরিষ্কার টিথার (Teether) বা ঠান্ডা পরিষ্কার কাপড় চিবোতে দিতে পারেন।
৬ষ্ঠ মাস: সলিড খাবারের শুরু (Weaning)
কী খাওয়াবেন: প্রথম দিন শুধু চালের সুজি বা চটকানো ভাত দিন। এরপর ধীরে ধীরে সবজি খিচুড়ি, ডাল, পাকা কলা বা আপেল পিউরি শুরু করুন। নিয়ম: নতুন খাবার ৩ দিনের নিয়ম (3-Day Rule) মেনে দিন। অর্থাৎ একটা নতুন খাবার দিলে পর পর ৩ দিন অন্য নতুন কিছু দেবেন না। এতে অ্যালার্জি থাকলে বোঝা যাবে। লবণ ও চিনি: ১ বছরের নিচের শিশুর খাবারে ভুলেও লবণ বা চিনি মেশাবেন না। এটি কিডনির ক্ষতি করতে পারে।
পর্ব ৩: ৭ থেকে ৯ মাস (হামাগুড়ি ও বসতে শেখা)
৭ম মাস: নিজে বসা
খাবার: খাবারের ঘনত্ব বাড়ান। ব্লেন্ড করা খাবার বাদ দিয়ে হাত দিয়ে চটকানো খাবার দিন, যাতে সে চিবানো শেখে। ডিমের কুসুম শুরু করতে পারেন।
৮ম মাস: হামাগুড়ি (Crawling)
বেবি প্রুফিং: ঘরের নিচু প্লাগ পয়েন্টগুলোতে টেপ লাগিয়ে দিন। মেঝেতে ছোট পয়সা, বোতাম বা পুঁথি যেন পড়ে না থাকে। এই বয়সের বাচ্চারা যা পায় তাই মুখে দেয়।
৯ম মাস: সেপারেশন অ্যাংজাইটি
টিপস: লুকোচুরি বা 'পিক-আ-বু' খেলুন। এতে সে বুঝবে মা চলে গেলেও আবার ফিরে আসে। আঙুলের ব্যবহার: সে এখন তর্জনী ও বুড়ো আঙুল দিয়ে ছোট জিনিস (যেমন মুড়ি) ধরতে পারবে। একে 'পিন্সার গ্রাস্প' বলে। নিজ হাতে খেতে উৎসাহিত করুন।
পর্ব ৪: ১০ থেকে ১২ মাস (স্বাধীনতার দিকে যাত্রা)
১০ম মাস: আসবাবপত্র ধরে দাঁড়ানো
পুষ্টি: মায়ের দুধের পাশাপাশি দিনে ৩ বার প্রধান খাবার এবং ২ বার নাস্তা দিন। ফলের রস না দিয়ে আস্ত ফল চটকে দিন।
১১তম মাস: কথা বলা ও অনুকরণ
বই পড়া: শিশুর হাতে শক্ত মলাটের ছবির বই দিন। ছবি দেখিয়ে নাম বলুন। এতে তার শব্দভাণ্ডার বাড়বে।
১২তম মাস: প্রথম জন্মদিন ও হাঁটা
পারিবারিক খাবার: ১ বছর হলে শিশু পরিবারের সবার সাথে বসে সাধারণ খাবার (অল্প ঝাল-লবণ যুক্ত) খেতে পারবে। গরুর দুধ: ১ বছর পূর্ণ হলে ডাক্তাররা গরুর দুধ দেওয়ার অনুমতি দেন। তবে মায়ের দুধ ২ বছর পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া উচিত।
সাধারণ সমস্যা ও সমাধান
সমাধান: প্রতিবার ডায়পার বদলানোর সময় স্থানটি ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে নিন। জিংক অক্সাইড যুক্ত ক্রিম লাগান। দিনের কিছুটা সময় ডায়পার ছাড়া খোলা হাওয়ায় রাখুন।
সমাধান: খাওয়ার পর পিঠে চাপড় দিয়ে ঢেকুর তোলান। পেটে ক্লক-ওয়াইজ ম্যাসাজ করুন বা সাইক্লিং ব্যায়াম করান।
সমাধান: জোর করবেন না। তরল খাবার বা সুপ দিন। খিদে পেলে সে নিজেই খাবে।
প্রচলিত কিছু কুসংস্কার (Myths) বনাম বাস্তবতা
মিথ: বাচ্চার চোখে কাজল দিলে চোখ বড় হয়। বাস্তবতা: কাজল চোখের জন্য ক্ষতিকর। এতে থাকা সীসা শিশুর স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে এবং চোখ দিয়ে পানি পড়ার সমস্যা সৃষ্টি করে।
মিথ: জন্মের পর মধু খাওয়ালে মুখের কথা মিষ্টি হয়। বাস্তবতা: ১ বছরের নিচের শিশুকে মধু খাওয়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এতে 'বটুলিজম' নামক মারাত্মক রোগ হতে পারে।
মিথ: মাথা কামালে চুল ঘন হয়। বাস্তবতা: চুলের ঘনত্ব জেনেটিক বা বংশগত। বারবার মাথা কামালে চুলের ফলিকল নষ্ট হতে পারে।
সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)
উপসংহার
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *




.webp)
 (1080 x 1080 px).webp)
.webp)
.webp)
.webp)