https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Trust.webp
Breaking News

শিশুর গোসলে যে ৫টি মারাত্মক ভুলে হতে পারে ত্বকের ইনফেকশন ও একজিমা: মা-বাবাদের জন্য জরুরি সতর্কবার্তা

top-news
  • 16 Dec, 2025
https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/eporichoy.webp

ভালো করতে গিয়ে ক্ষতি করছেন না তো?

আমাদের দেশে একটি শিশুর জন্ম মানেই পুরো পরিবারের আনন্দ। আর এই নবজাতক বা ছোট বাচ্চার যত্ন-আত্তি নিয়ে আমাদের মা-বাবা, দাদা-দাদী বা আত্মীয়-স্বজনের চেষ্টার কোনো কমতি থাকে না। বিশেষ করে বাচ্চার 'গোসল' নিয়ে আমাদের আবেগের শেষ নেই। আমরা মনে করি, বাচ্চাকে যত বেশি ঘষে-মেজে পরিষ্কার করব, বা পানিতে যত বেশি অ্যান্টিসেপটিক মেশাবো, বাচ্চা তত সুস্থ থাকবে।

কিন্তু আপনি কি জানেন? আমাদের এই অতিরিক্ত সচেতনতা বা প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা বাচ্চার উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করছে। শিশুর ত্বক বড়দের ত্বকের মতো নয়; এটি ৫ গুণ বেশি পাতলা এবং অত্যন্ত সংবেদনশীল। গোসলের সময় সামান্য অসতর্কতা বা ভুল প্রসাধনীর ব্যবহার বাচ্চার ত্বকে দীর্ঘস্থায়ী একজিমা, ফাঙ্গাল ইনফেকশন বা মারাত্মক চর্মরোগের কারণ হতে পারে।

একজন অভিজ্ঞ অভিভাবক এবং শিশু যত্ন বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিকোণ থেকে আজ আমরা আলোচনা করব এমন ৫টি কমন মিস্টেক বা ভুল নিয়ে, যা আমরা প্রায়শই করি। এবং জানব, কীভাবে আমাদের আবহাওয়ায় (বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে) শিশুকে সঠিক উপায়ে গোসল করানো উচিত।


ভুল ১: গোসলের পানিতে অ্যান্টিসেপটিক লিকুইড (যেমন ডেটল বা স্যাভলন) মেশানো

এটি বাংলাদেশের ঘরে ঘরে প্রচলিত সবচেয়ে বড় ভুলগুলোর একটি। আমরা মনে করি, পানিতে একটু অ্যান্টিসেপটিক লিকুইড মিশিয়ে দিলে বাচ্চার শরীর জীবাণুমুক্ত হবে। বিশেষ করে বর্ষাকালে বা গরমের দিনে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

কেন এটি ক্ষতিকর?
শিশুর ত্বকে প্রাকৃতিকভাবেই কিছু 'ভালো ব্যাকটেরিয়া' বা 'মাইক্রোবায়োম' থাকে, যা তাদের ত্বককে বাইরের ক্ষতিকর জীবাণু থেকে রক্ষা করে। আপনি যখনই কড়া অ্যান্টিসেপটিক পানিতে মেশান, তখন এটি ক্ষতিকর জীবাণুর পাশাপাশি ত্বকের উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোকেও মেরে ফেলে।
এর ফলে:
১. ত্বকের প্রাকৃতিক পিএইচ (pH) ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যায়।
২. ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক ও খসখসে হয়ে যায়।
৩. দীর্ঘমেয়াদে একজিমা বা সোরিয়াসিসের মতো রোগ দেখা দিতে পারে।

সঠিক নিয়ম:
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গোসলের পানিতে কখনোই কোনো অ্যান্টিসেপটিক মেশাবেন না। সাধারণ টিউবওয়েলের পানি বা ফুটানো কুসুম গরম পানিই বাচ্চার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ।


ভুল ২: খুব জোরে ঘষে পরিষ্কার করা এবং সাবান বা জালি ব্যবহার

বাচ্চাকে গোসল করানোর সময় অনেক মা বা নানি-দাদিরা মনে করেন, বাচ্চার গায়ের ময়লা তুলতে হলে একটু জোরে ডলতে হবে। অনেকে বড়দের নাইলনের জালি বা শক্ত তোয়ালে দিয়ে বাচ্চার শরীর ঘষেন।

লুকায়িত বিপদ:
শিশুর ত্বকের ওপরের স্তর (Epidermis) খুবই নাজুক। জোরে ঘষাঘষি করলে এই স্তরে অদেখা ফাটল (Micro-tears) তৈরি হয়। এই ফাটল দিয়ে সহজেই ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস চামড়ার ভেতরে প্রবেশ করে ইনফেকশন তৈরি করে। যাকে আমরা অনেক সময় 'মাজানি ঘা' বা ইমপেটিগো (Impetigo) বলে থাকি।

সঠিক নিয়ম:
বাচ্চার শরীর পরিষ্কার করতে আপনার হাতের স্পর্শই যথেষ্ট। খুব বেশি হলে নরম সুতি কাপড় বা বেবি স্পঞ্জ ব্যবহার করতে পারেন। সাবান ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সতর্ক হোন। বড়দের সাবান বা অতিরিক্ত ক্ষারযুক্ত সাবান বাচ্চার ত্বকের আর্দ্রতা কেড়ে নেয়। সবসময় 'টিয়ার-ফ্রি' এবং 'পিএইচ ব্যালেন্সড' (pH 5.5) বেবি ওয়াশ ব্যবহার করুন।


ভুল ৩: ভেজা শরীরে তেল বা লোশন মাখানো এবং ভাঁজগুলো না মোছা

গোসলের পর বাচ্চার শরীর মোছানোর সময় আমরা প্রায়ই তাড়াহুড়ো করি। বিশেষ করে বাচ্চার ঘাড়ের ভাঁজ, বগলের নিচ, কুঁচকি (Groin area) এবং পায়ের আঙুলের ফাঁকগুলো ঠিকমতো শুকনো হয় না। এর ওপরই আমরা তেল বা লোশন মেখে দিই।

কেন এটি ইনফেকশনের কারণ?
বাংলাদেশের আবহাওয়া আর্দ্র। শরীরের ভাঁজগুলোতে পানি জমে থাকলে এবং তার ওপর তেল মাখলে সেখানে বাতাস চলাচল করতে পারে না। এই স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ ফাঙ্গাস (Fungal Infection) বা ক্যান্ডিডা (Candida) জন্মানোর জন্য আদর্শ জায়গা। এর ফলে বাচ্চার গলায় বা কুঁচকিতে লাল চাকা চাকা দাগ বা র‍্যাশ দেখা দেয়।

সঠিক নিয়ম:
গোসলের পর নরম সুতি গামছা বা তোয়ালে দিয়ে চেপে চেপে (ঘষে নয়) বাচ্চার শরীর মুছুন। প্রতিটি ভাঁজ চেক করুন। ত্বক পুরোপুরি শুকানোর পর ময়েশ্চারাইজার লাগান। মনে রাখবেন, সরিষার তেল মাখলে যদি বাচ্চার র‍্যাশ হয়, তবে তা অবিলম্বে বন্ধ করে নারিকেল তেল বা ভালো মানের বেবি লোশন ব্যবহার করা উচিত।


ভুল ৪: পানির তাপমাত্রা ঠিক না রাখা (অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা)

শীতকালে আমরা অনেক সময় বাচ্চার ঠান্ডা লাগবে ভেবে অতিরিক্ত গরম পানি ব্যবহার করি। আবার গরমে ডাইরেক্ট ট্যাংকের ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করাই। দুটিই ত্বকের জন্য ক্ষতিকর।

সমস্যা কোথায়?

  • অতিরিক্ত গরম পানি: এটি ত্বকের ন্যাচারাল অয়েল বা সিবাম ধুয়ে ফেলে, ফলে ত্বক ফেটে যায় এবং চুলকানি শুরু হয়।

  • অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি: এটি বাচ্চার শরীরের তাপমাত্রা কমিয়ে দেয় (Hypothermia) এবং কোল্ড অ্যালার্জির সমস্যা বাড়ায়।

সঠিক নিয়ম:
বাচ্চার গোসলের পানি সবসময় 'কুসুম গরম' (Lukewarm) হতে হবে। পানির তাপমাত্রা মাপার জন্য থার্মোমিটার না থাকলে আপনার কনুই ডুবিয়ে পরীক্ষা করুন। যদি কনুইতে আরামদায়ক মনে হয়, তবেই তা বাচ্চার জন্য নিরাপদ।


ভুল ৫: দীর্ঘ সময় ধরে গোসল করানো

বাচ্চা পানিতে খেলতে পছন্দ করে বলে আমরা অনেকেই তাকে ১০-১৫ মিনিট বা তারও বেশি সময় ধরে পানিতে চুবিয়ে রাখি বা বাথটাবের পানিতে বসিয়ে রাখি।

ক্ষতিকর দিক:
বেশি সময় পানিতে থাকলে ত্বকের কোষগুলো পানি শুষে ফুলে যায় এবং পরবর্তীতে দ্রুত শুকিয়ে কুঁচকে যায়। একে 'প্রুনিং' বলে। এটি ত্বকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয় এবং বাইরের কেমিক্যাল বা সাবান ত্বকের গভীরে ঢোকার সুযোগ পায়।

সঠিক নিয়ম:
নবজাতকের জন্য ৫ মিনিট এবং একটু বড় বাচ্চার জন্য সর্বোচ্চ ১০ মিনিটের মধ্যে গোসল শেষ করা উচিত।


বাচ্চার ত্বকের সুরক্ষায় কিছু এক্সট্রা টিপস ও সতর্কতা

উপরে উল্লিখিত ৫টি ভুল শুধরে নেওয়ার পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে:

১. গোসলের সময় নির্ধারণ:
প্রতিদিন একই সময়ে গোসল করানোর চেষ্টা করুন। রোদ থাকাকালীন, যেমন সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে গোসল করানো সবচেয়ে ভালো। এতে বাচ্চার ঠান্ডা লাগার প্রবণতা কমে।

২. শ্যাম্পু ব্যবহারে সতর্কতা:
মাথায় খুশকি বা ক্র্যাডল ক্যাপ (Cradle Cap) হলে জোর করে নখ দিয়ে খুঁটবেন না। গোসলের আগে তেল দিয়ে নরম করে, পরে শ্যাম্পু করে আলতোভাবে ব্রাশ বা চিরুনি দিয়ে পরিষ্কার করুন।

৩. পোশাক নির্বাচন:
গোসলের পর বাচ্চাকে সিন্থেটিক বা উলের কাপড় সরাসরি পরাবেন না। প্রথমে একটি পাতলা সুতি জামা পরিয়ে তার ওপর অন্য কাপড় পরাবেন। এতে ত্বকে ঘাম জমে র‍্যাশ হওয়ার ঝুঁকি কমে।


প্রচলিত কিছু কুসংস্কার বনাম বিজ্ঞান (Myths vs Facts)

  • কুসংস্কার: জ্বর বা সর্দি হলে বাচ্চাকে গোসল করানো যাবে না।

    • বিজ্ঞান: কুসুম গরম পানিতে দ্রুত গোসল বা স্পঞ্জ করালে বাচ্চার শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং সে আরামবোধ করে। তবে অবশ্যই গোসলের পর দ্রুত শরীর ও মাথা মুছিয়ে দিতে হবে।

  • কুসংস্কার: গায়ের রং ফর্সা করার জন্য কাঁচা হলুদ বা বেসন দিয়ে গোসল করানো।

    • বিজ্ঞান: কাঁচা হলুদ বা বেসন অনেক শিশুর ত্বকে তীব্র অ্যালার্জি সৃষ্টি করতে পারে। গায়ের রং জিনগত, এটি সাবান বা হলুদ দিয়ে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।


সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)

প্রশ্ন: নবজাতককে কি প্রতিদিন গোসল করানো উচিত?
উত্তর: না, নবজাতককে প্রতিদিন গোসল করানোর প্রয়োজন নেই। সপ্তাহে ২-৩ দিন সাবান দিয়ে গোসল করানোই যথেষ্ট। বাকি দিনগুলোতে শরীর স্পঞ্জ করে দিলেই হবে। তবে বাচ্চা হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করলে বা বেশি ঘামলে প্রতিদিন গোসল করানো যেতে পারে।

প্রশ্ন: কোন তেল বাচ্চার জন্য সবচেয়ে ভালো?
উত্তর: গরমে ভার্জিন কোকোনাট অয়েল (নারিকেল তেল) সবচেয়ে নিরাপদ। শীতে অলিভ অয়েল বা আমন্ড অয়েল ব্যবহার করতে পারেন। সরিষার তেল ঝাঁঝালো হওয়ায় অনেক শিশুর ত্বকে এটি সহ্য হয় না, তাই ব্যবহারের আগে 'প্যাচ টেস্ট' করে নেওয়া উচিত।

প্রশ্ন: নাভি না পড়া পর্যন্ত কি গোসল করানো যাবে?
উত্তর: নাভি না পড়া পর্যন্ত বাচ্চাকে পানিতে ডুবিয়ে গোসল না করানোই ভালো। এতে নাভি পেকে যাওয়ার ভয় থাকে। এই সময়টুকু স্পঞ্জ বাথ (ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মোছানো) দেওয়া উচিত।


উপসংহার

আপনার সোনামণির ত্বক ফুলের পাপড়ির মতোই কোমল। গোসলের সময় আমাদের ছোট ছোট ভুলগুলোই এই কোমল ত্বকের বড় শত্রুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অ্যান্টিসেপটিক পরিহার করা, পানির তাপমাত্রা ঠিক রাখা, জোরে না ঘষা এবং ঠিকমতো শরীর শুকানো—এই সাধারণ নিয়মগুলো মেনে চললে আপনার শিশু থাকবে চর্মরোগমুক্ত, ঝরঝরে এবং প্রাণবন্ত। মনে রাখবেন, বাচ্চার যত্নে "বেশি মানেই ভালো নয়", বরং "সঠিক ও নিরাপদ যত্নই আসল।"



https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Genus.webp

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *