https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Trust.webp
Breaking News

সুন্দরবনের গহীনে: যেখানে শ্বাসমূল আর রয়েল বেঙ্গলের রাজত্ব (প্রকৃতির অকৃত্রিম রূপ)

top-news
  • 06 Dec, 2025
https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/eporichoy.webp

বাংলাদেশের মানচিত্রের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে তাকালে যে গাঢ় সবুজ অংশটি চোখে পড়ে, সেটি কেবল কোনো জঙ্গল নয়; সেটি আমাদের ফুসফুস, আমাদের গর্ব—সুন্দরবন। নোনা জল আর কাদার গন্ধে মাখা এই বনের প্রতিটি বাঁকে লুকিয়ে আছে রহস্য। এখানে প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে চলে, যেখানে মানুষের আইন খাটে না, চলে কেবল 'জোর যার মুলুক তার' নীতি। আজ আমরা রাজনীতির জটিল সমীকরণ বা মানুষের জীবিকার লড়াইয়ের বাইরে গিয়ে, শুধু প্রকৃতির চশমা দিয়ে দেখব এই অবিশ্বাস্য সুন্দরবনকে। হারিয়ে যাব বাদাবনের গহীনে, যেখানে বাঘের ডেরা আর কুমিরের রাজত্ব।

সুন্দরবনকে বুঝতে হলে আগে এর চরিত্র বুঝতে হবে। এটি সাধারণ কোনো বন নয়। এটি একটি 'ম্যানগ্রোভ' ফরেস্ট, যেখানে গাছপালাকে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয় নোনা পানির সাথে। দিনে দুবার জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় বনের বিশাল অংশ, আবার ভাটায় জেগে ওঠে কর্দমাক্ত মাটি। এই অদ্ভুত ল্যান্ডস্কেপ বা ভূপ্রকৃতিই সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীদের চরিত্র গঠন করেছে।

১. বনের রাজা: রয়েল বেঙ্গল টাইগার

সুন্দরবনের নাম নিলেই প্রথমে যার ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সে হলো আমাদের জাতীয় পশু—রয়েল বেঙ্গল টাইগার। কিন্তু সুন্দরবনের বাঘ আর চিড়িয়াখানার বাঘের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। সুন্দরবনের বাঘ হলো বিশ্বের একমাত্র বাঘ প্রজাতি যারা ম্যানগ্রোভে বাস করতে অভ্যস্ত।

এখানকার বাঘেরা অসম্ভব ভালো সাঁতারু। আপনি হয়তো বোটে করে খালের মাঝ দিয়ে যাচ্ছেন, হঠাৎ দেখবেন হলুদ-কালো ডোরাকাটা একটি বিশাল শরীর অবলীলায় নদী পার হচ্ছে। নোনা পানি তাদের কাছে কোনো বাধা নয়। ইকোলজিক্যাল বা বাস্তুসংস্থানগত দিক থেকে এই বাঘেরা হলো 'অ্যাপেক্স প্রিডেটর' বা খাদ্যশৃঙ্খলের একেবারে ওপরের খাদক।

সুন্দরবনের বাঘের আচরণ বা বিহেভিয়ার নিয়ে গবেষকদের কৌতূহলের শেষ নেই। এরা সাইজে সাইবেরিয়ান বাঘের চেয়ে ছোট হলেও, অনেক বেশি ক্ষিপ্র এবং বুদ্ধিমান। এখানকার মাটি কাদালেপা, তাই বাঘের পায়ের ছাপ বা 'পাগমার্ক' দেখে বনরক্ষীরা বুঝতে পারেন মামা (স্থানীয়রা বাঘকে মামা ডাকে) কোন দিকে গেছে। এই বাঘেদের শরীর এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে তারা এই নোনা জল খেয়েও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। তবে মিষ্টি পানির পুকুর পেলে তারা সেটাকেই প্রাধান্য দেয়।

বাঘের এই উপস্থিতিও সুন্দরবনের ইকো-ব্যালেন্স বা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য অপরিহার্য। বাঘ আছে বলেই হরিণ বা শুকরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। যদি বাঘ না থাকত, তবে তৃণভোজী প্রাণীরা বনের সব গাছপালা খেয়ে বন উজাড় করে দিত। অর্থাৎ, বাঘ শুধু ভয়ের প্রতীক নয়, বাঘ হলো এই বনের রক্ষক।

২. মায়ার জগত: চিত্রা হরিণ (Spotted Deer)

বাঘের পরেই সুন্দরবনের যে প্রাণীটি পর্যটকদের মন কেড়ে নেয়, তা হলো মায়াবী চোখের চিত্রা হরিণ। কটকা বা কচিখালীর জামতলার বিচে ভোরে বা গোধূলিতে যখন হরিণের পাল ঘাস খেতে বের হয়, সেই দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সবুজের পটে তাদের সোনালী গায়ের ওপর সাদা ফোঁটাগুলো যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা।

কিন্তু চিত্রা হরিণের জীবন মোটেও সহজ নয়। তাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। কান খাড়া করে তারা বাতাসের শব্দ শোনে। মজার ব্যাপার হলো, সুন্দরবনের হরিণ আর বানরের মধ্যে এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব রয়েছে। বানর থাকে গাছের ডালে, আর হরিণ থাকে নিচে। বানর উপর থেকে কচি পাতা বা কেওড়ার ফল ছিঁড়ে নিচে ফেলে, যা হরিণ খুব মজা করে খায়। আবার বাঘ যখন শিকার করতে আসে, তখন গাছের ওপর থেকে বানর বিশেষ এক ধরনের শব্দ করে হরিণকে সতর্ক করে দেয়। এই যে মিউচুয়ালিজম বা পারস্পরিক সহযোগিতা, এটাই সুন্দরবনের ইকোলজির এক অনন্য নিদর্শন।

৩. জলের দানব: লোনা পানির কুমির (Saltwater Crocodile)

সুন্দরবনের খালগুলো যতটা শান্ত দেখা যায়, আসলে ততটাই বিপদজনক। ভাটার সময় খালের পাড়ে কাদামাটিতে রোদ পোহাতে দেখা যায় বিশাল সব লোনা পানির কুমিরকে। এরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সরীসৃপদের একটি। একেকটি কুমির লম্বায় ২০ ফুটের বেশিও হতে পারে।

এদের গায়ের রঙ কাদার সাথে এমনভাবে মিশে থাকে যে আপনি বুঝতেই পারবেন না ওটা কাঠের গুড়ি নাকি কুমির। শিকার ধরার সময় এদের ধৈর্য দেখার মতো। ঘন্টার পর ঘন্টা নড়াচড়া না করে এরা ওৎ পেতে থাকে। জল খেতে আসা হরিণ বা বানর এদের প্রধান শিকার। সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমে এই কুমিরগুলো নদীর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। এরা মরা বা অসুস্থ মাছ খেয়ে জল পরিষ্কার রাখে এবং মাছের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে।

৪. বানরের ফাজলামি: রেসাস মাকাও

সুন্দরবনের অন্যতম চঞ্চল বাসিন্দা হলো রেসাস মাকাও প্রজাতির বানর। বনের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে এদের দেখা মেলে না। তবে এরা শুধু দুষ্টুমিই করে না, বনের বিস্তারে এদের ভূমিকা অনেক। এরা ফল খেয়ে বীজগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়, যা থেকে নতুন গাছ জন্মায়।

পর্যটকদের বোট দেখলেই এরা দলবেঁধে পাড়ে চলে আসে। তবে সাবধান! এরা কিন্তু সুযোগ পেলেই খাবার ছিনতাই করতে ওস্তাদ। এদের সামাজিক জীবন খুব শক্তিশালী। দলের নেতা বা 'আলফা মেল' পুরো দলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

৫. ডলফিনের রাজ্যে: শুশুক আর ইরাবতী

সুন্দরবনের নদীগুলোতে দুই ধরনের ডলফিনের দেখা মেলে—গাঙ্গেয় ডলফিন (শুশুক) এবং ইরাবতী ডলফিন। শুশুক সাধারণত ঘোলা পানিতে থাকে এবং মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস নিতে ভেসে ওঠে। এদের লম্বা ঠোঁট বা স্নাউট থাকে। অন্যদিকে ইরাবতী ডলফিনের মাথাটা গোলাকার এবং এরা একটু বেশি লাজুক।

সুন্দরবনের নদীগুলোর মোহনা, বিশেষ করে যেখানে তিনটি নদী মিলিত হয়েছে, সেখানে এদের বেশি দেখা যায়। ডলফিন থাকা মানেই হলো নদীর পানি দূষণমুক্ত এবং সেখানে প্রচুর মাছ আছে। অর্থাৎ ডলফিন হলো নদীর স্বাস্থ্যের সূচক।

৬. পাখির স্বর্গরাজ্য

পাখিপ্রেমীদের জন্য সুন্দরবন এক স্বর্গ। এখানে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখির বাস। এর মধ্যে সবচেয়ে আইকনিক হলো মাছরাঙা। সুন্দরবনে প্রায় ৮-৯ প্রজাতির মাছরাঙা দেখা যায়। ব্রাউন-উইংড কিংফিশার (Brown-winged Kingfisher), ব্ল্যাক-ক্যাপড কিংফিশার (Black-capped Kingfisher) এবং কলার্ড কিংফিশার—এদের রঙের ছটা আপনাকে মুগ্ধ করবেই।

ভোরের কুয়াশা ভেদ করে যখন মদন টাক (Lesser Adjutant) বা শামুকখোল উড়ে যায়, তখন মনে হয় সময় থমকে গেছে। এ ছাড়া আছে সাদা বুকের সমুদ্র ঈগল (White-bellied Sea Eagle)। বিশাল ডানা মেলে এরা যখন আকাশের অনেক উঁচুতে ভাসে, তখন নিচে থাকা মাছ বা সাপ ভয়ে তটস্থ থাকে। প্যাঁচা, বক, পানকৌড়ি আর শালিকের আনাগোনা তো আছেই। শীতকালে এর সাথে যোগ হয় হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি।

৭. কাদার রাজ্যের ক্ষুদ্র বাসিন্দারা

বড় প্রাণীদের ভিড়ে আমরা প্রায়ই ছোটদের কথা ভুলে যাই। কিন্তু সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রে এদের গুরুত্ব অপরিসীম। ভাটার সময় মাটির দিকে তাকালে দেখবেন লাল, নীল বা হলুদ রঙের হাজার হাজার কাঁকড়া। এদের বলা হয় ফিডলার ক্র্যাব (Fiddler Crab)। এদের একটি দাড়া বা চিমটা শরীরের তুলনায় অনেক বড় হয়, যা দিয়ে তারা একে অপরকে সংকেত দেয়।

আর আছে মাডস্কিপার (Mudskipper) বা বাইন মাছের মতো দেখতে অদ্ভুত এক প্রাণী। এরা মাছ হলেও ডাঙায় হাঁটতে পারে! বুকের কাছে থাকা বিশেষ এক জোড়া পাখনার সাহায্যে এরা কাদার ওপর লাফিয়ে চলে। এরা উভচর প্রাণীদের বিবর্তনের এক জীবন্ত প্রমাণ। এই কাঁকড়া আর মাডস্কিপাররা মাটির উর্বরতা বাড়াতে সাহায্য করে, যা ম্যানগ্রোভ গাছের জন্য খুব জরুরি।

৮. সুন্দরবনের গাছপালা: শ্বাসমূলের রহস্য

প্রাণীদের পাশাপাশি সুন্দরবনের উদ্ভিদের কথাও বলতেই হবে। এখানকার মাটি লবণাক্ত এবং অক্সিজেনের অভাব রয়েছে। তাই গাছগুলো বেঁচে থাকার জন্য এক অদ্ভুত উপায় বের করেছে। সুন্দরী, গরান, গেওয়া, কেওড়া—এসব গাছের শেকড় মাটির নিচে না গিয়ে মাটির ওপরে উঠে আসে বাতাসের খোঁজে। এদের বলা হয় শ্বাসমূল বা নিউমাটোফোর (Pneumatophores)।

এই শ্বাসমূলগুলো দেখতে অনেকটা পেরেকের মতো। পুরো বনের মাটিজুড়ে এগুলো ছড়িয়ে থাকে। এটি শুধু গাছকে শ্বাস নিতেই সাহায্য করে না, জোয়ারের সময় মাটিকে ধরে রাখতেও সাহায্য করে। অর্থাৎ সুন্দরবন টিকে আছে তার এই অদ্ভুত শেকড় ব্যবস্থার ওপর।

৯. সরীসৃপের রাজত্ব

কুমির ছাড়াও সুন্দরবনে আছে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ। এর মধ্যে শঙ্খচুড় বা কিং কোবরা এবং অজগর সাপ (Python) উল্লেখযোগ্য। অজগর সাপ সাধারণত গাছে পেঁচিয়ে থাকে বা মাটির গর্তে বিশ্রাম নেয়। এরা বিষাক্ত নয়, কিন্তু শিকারকে পেঁচিয়ে হাড়গোড় ভেঙে ফেলে। এ ছাড়া আছে গুইসাপ। বিশাল আকৃতির গুইসাপ বা মনিটর লিজার্ড যখন জিভ বের করে হাঁটে, তখন তাকে জুরাসিক পার্কের ডাইনোসরের মতো মনে হয়।

১০. ইকোলজিক্যাল চ্যালেঞ্জ এবং আমাদের দায়বদ্ধতা

সুন্দরবন প্রাকৃতিকভাবেই অনেক প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে টিকে আছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে, ফলে বনের ভেতরে লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে সুন্দরী গাছের আগা মরে যাওয়ার রোগ (Top dying disease) দেখা দিচ্ছে। বাঘের মিষ্টি পানির উৎস কমে যাচ্ছে।

তবুও সুন্দরবন ঢাল হয়ে আমাদের রক্ষা করে। সিডর, আইলা বা আম্পানের মতো ঘূর্ণিঝড়গুলো সুন্দরবনের ওপর দিয়েই প্রথমে আঘাত হানে। বন নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আমাদের বাঁচায়। এই বনের প্রতিটি প্রাণী, প্রতিটি গাছ, এমনকি কাদার নিচের ওই ছোট কাঁকড়াটিও প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

উপসংহার

সুন্দরবন ভ্রমণ মানে শুধু বাঘ দেখা নয়। এটি হলো প্রকৃতির এক বিশাল পাঠশালায় প্রবেশ করা। যখন লঞ্চের ডেকে বসে আপনি কফি খেতে খেতে সূর্যাস্ত দেখবেন, আর দূরে কোনো হরিণ শাবকের ডাক শুনবেন, তখন আপনি অনুভব করবেন—আমরা এই প্রকৃতির মালিক নই, আমরা এর অংশ মাত্র।
রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন, চিত্রা হরিণের মায়াভরা চাহনি, আর শ্বাসমূলের অদ্ভুত জ্যামিতি—সব মিলিয়ে সুন্দরবন এক অপার রহস্যের নাম। এই রহস্যকে বাঁচিয়ে রাখা, এই বন্যপ্রাণীদের তাদের মতো করে থাকতে দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আসুন, আমরা সুন্দরবনকে ভালোবাসি, কিন্তু দূর থেকে, শ্রদ্ধার সাথে।

https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Genus.webp

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *